Wednesday, January 23, 2013

ছাত্রলীগ এবার প্রকাশ্য এসিড সন্ত্রাসে

লিখেছেন এম.আবদুল হাই : ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে ছাত্র সমাজের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে ছাত্ররা যখন অপরাধ জগতে ঝুঁকে পড়ে এবং স্বার্থাহ্নেষী মহল কর্তৃক হীন উদ্দেশ্য চরিতাথে ব্যবহৃত হয় তখন তা সমগ্র জাতীর জন্য অত্যন্ত দু:খ জনক। বিভ্ন্নি দলের ছাত্ররা লেখা-পড়ার চেয়ে অপরাধ জগতে ধাবিত হচ্ছে ইদানিং অধিক হারে। বিভিন্ন অপরাধে শীর্ষস্থান দখলের পর এবার ছাত্রলীগের অভিষেক ঘটল ‘এসিড সন্ত্রাসী’ হিসেবে! সম্প্রতি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত নীরিহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে এসিড নিক্ষেপসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা। তাদের এ হামলায় ৪ শিক্ষক ও ২৫ শিক্ষার্থী আহত হন। তম্মধ্যে এসিডদগ্ধ দুই শিক্ষকের অবস্থা গুরুতর।
তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন স্থানে বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডার বাহিনী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেয়। তাদের ওপর দফায় দফায় স্বসস্ত্র হামলাসহ ভাংচুর চালিয়ে ও ককটেল ফাটিয়ে সৃষ্টি করে বিভিষিকাময় আতংক। উলে¬খ্য, উপাচার্য ড. মু. আবদুল জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও অত্মীয়করণসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর আগেও ছাত্রলীগ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। তবে শিক্ষকদের ওপর এ ধরনের হামলা নজিরবিহীন। ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও নিন্দনীয়।
বর্তমান সরকারের গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে সহিংস আচরণ, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি কারণে ছাত্রলীগ বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। তাদের আচরণে একপর্যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বেআইনি কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের সতর্ক করেও দিয়েছিলেন বারবার। এমনকি একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোরও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরপরও ছাত্রলীগের তাণ্ডব বন্ধতো হয়ইনি, এতটুকুন পরিবর্তনও আসেনি তাদের আচরণে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে সরকার কি তাদের নিজ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম? নাকি অপরাধে তারা এতই দুর্ধস্ব যে, তারা নেতা-নেত্রী নিয়ন্ত্রণের অনেক বাইরে চলে যাচ্ছে। গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগে গুটিকয় হাইব্রিড ও ফরমালিন ঢুকে পড়েছে, যাদের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে না। বাস্তবতা হল, দেশব্যাপী অবলীলায় ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের ফলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে। প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা ছাত্রলীগে ঢুকেছে তা বড় বিষয় নয়, ছাত্রলীগ নামধারী কেউ কোন অপকর্ম ঘটালে তার দায় সরকারের ওপরই বর্তায়। জনগণও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখে। সরকারকে বুঝতে হবে, ছাত্রলীগের যে কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে দমন করা না হলে এ প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও শিক্ষক রাজনীতি ও দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ প্রবণতাও অনেকাংশে দায়ী। লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির কারণে যখন যে দল ক্ষমতাসীন থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য অবধারিত হয়ে ওঠে। আর দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগের কারণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোন অপকর্ম করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে উপাচার্যের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই উঠুক, তাকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা আমরা দেখেছি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেখা যাচ্ছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ নামধারীরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত উপাচার্যকে রক্ষায় শিক্ষকদের ওপর এসিড নিক্ষেপের ন্যায় জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধা করেনি। ছাত্ররাজনীতির বর্তমান ধারা ছাত্রলীগকে কোন পর্যায়ে নামিয়েছে, এ ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোন্ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কে উপাচার্য হবেন, শিক্ষক হিসেবে কাদের নিয়োগ দেয়া হবে, হলগুলোয় কোন্ শিক্ষার্থীরা থাকবেন তার প্রায় সবকিছুই নির্ভর করছে ছাত্রলীগের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। এমন দলবাজি ও দলীয়করণের পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে, সম্প্রতি পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে বিশ্বজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড তারই একটি বড় উদাহরণ। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ও বর্তমান ক্ষমতাধর হিসেবে অপরাধী যেই হোক, তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করণের মাধমে রোধ হতে পারে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তথা ছাত্রলীগের মানবতা বিধ্বংসী বেপরোয়াপনা। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ছাড়াও মূল সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে এ সরকারের ইমেজ রক্ষাসহ জনগণের মাঝে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন থাকার বৃহত্তর স্বার্থে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।

লেখক : কলামিষ্ট